অতিথি পাখির আগমনে মুখর সিলেটের হাওর-বাওর 

অতিথি পাখির আগমনে মুখর সিলেটের হাওর-বাওর 

নূর আহমদ : অতিথি পাখির আগমনে মুখরিত হয়ে উঠেছে সিলেটের হাওর-বাওর। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ মিঠাপানির জলাশয় হিসেবেও পরিচিত হাকালুকি হাওরসহ সিলেটের দক্ষিণ সুরমার মোমিনখলা এলাকার বগলাজান হাওর, জৈন্তাপুরের লাল শাপলাবিলসহ বিভিন্ন হাওরে দেখা মিলছে অতিথি পাখির। তবে হাকালুকি হাওর,  হাইল হাওর ও বাইক্কা বিলে বরাবরের মতো এবারো অতিথি পাখি শিকারের অভিযোগ উঠেছে। 

গবেষকদের মতে, হাকালুকি হাওরে ছোট-বড়-মাঝারি সব মিলিয়ে ২৩৮টি বিল রয়েছে। এর মধ্যে বাইয়া, গজুয়া, হাওরখাল, রঞ্চি ও কলাপানি জলাশয়ে পাখির আধিক্য বেশি থাকে। এই হাওরটি শুধু দেশের নয়, এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ মিঠাপানির জলাশয় হিসেবেও পরিচিত। ১৮ হাজার ১১৫ হেক্টর আয়তনের এই হাওর মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার পাঁচটি উপজেলায় এটি বিস্তৃত। এর মধ্যে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় ৪০ শতাংশ, কুলাউড়া উপজেলায় ৩০ শতাংশ, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় ১৫ শতাংশ, গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ১০ শতাংশ ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় ৫ শতাংশ অংশ রয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, এবার হাওরে বালিহাঁস, ভুতিহাঁস, গিরিয়া হাঁস, ল্যাঞ্জা হাঁস, গুটি ঈগল, কুড়া ঈগল, সরালি, পানভুলানি, কালিম, টিটি, পেডিসহ অন্তত ১৫-২০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি এসেছে। তবে এর মধ্যে বালিহাঁস ও ভুতিহাঁসের সংখ্যাই বেশি। তাছাড়া সাদা বক, কানি বক, পানকৌড়ি, চিল, বাজসহ দেশীয় প্রজাতির নানা পাখিও রয়েছে।

অন্যদিকে, সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার ডিবির হাওর লাল শাপলা বিলেও এ বছর অতিথি পাখির আগমন ঘটেছে। দেখা মিলছে, বালি হাঁস, শামুকখোল, মেটেমাথাটিটি, সাদা বক, কানি বক, মাছ রাঙ্গা, নীলকন্ঠি, জল ময়ুর, সরালি হাঁস সহ অসংখ্য প্রজাতির পাখি। গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর সংখ্যায় বেশি অতিথি পাখির দেখা মিলেছে লাল শাপলার বিলে। 

সরেজমিনে লাল শাপলা বিলে দেখা গেছে, অতিথি পাখি লাল শাপলায় কলিতে ঠোকর দিচ্ছে, পানিতে ডুব দিচ্ছে, সাঁতার কাটছে এবং বিল জুড়ে নিরাপদে নড়াচড়া করছে। খানিক পর বিশ্রাম নিচ্ছে দল বেঁধে। পর্যটকেরাও এমন দৃশ্য উপভোগ করছেন নৌকায় চড়ে। যেন লাল শাপলার বিল গুলোতে পর্যটকদের স্বাগত জানাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখিগুলো। সারাদিন দেখা মিলে অতিথি পাখির।  তারা এ বিল হতে ঐ বিলে উড়ে বেড়াচ্ছে।

জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল আহমদ বলেন, লাল শাপলা বিলে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য উপজেলা পরিষদ, উপজেলা প্রশাসন নানা উন্নয়ন কর্মকান্ড করে যাচ্ছে। এর সুফল মিলছে। জৈন্তা ফটোগ্রাফি সোসাইটি নামের একটি সংগঠনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিতে ও তাদের অর্থায়নে বনায়ন সৃষ্টি করা হচ্ছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে বিলটি হয়ে উঠবে অতিথি পাখির নিরাপদ আবাসস্থল এবং উপজেলার অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। 

অন্যদিকে নগরীর হুমায়ূন রশীদ চত্বর হয়ে সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক দিয়ে এগিয়ে গেলেই ডান পাশে অবস্থান বগলাজান হাওরের। সেখানে গেলেই চোখে পড়বে শত শত পাতি সরালি কিচিরমিচির করছে, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে। খাবারের খোঁজ কিংবা নিজেদের মধ্যে খুনসুঁটি করে সময় কাটাচ্ছে পাখিগুলো। স্থানীয়রা জানান, সিলেট সিটি করপোরেশনের ২৫ ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে বগলাজান হাওর। হাওরটির আয়তন প্রায় ৯০০ একর। এর মধ্যে রেলওয়ের ও সরকারি খাস জায়গাও আছে। হাওরটিতে এবারই এত পাখি এসেছে। এর আগে এখানে এত পাখি দেখেননি আশপাশের লোকজন। সপ্তাহখানেক আগে থেকে পাখিগুলো হাওরটিতে আসতে শুরু করে।

মোমিনখলা এলাকার বাসিন্দা শামসুল আলম বলেন, পাখিগুলো নতুন দেখেছেন তিনি। এর আগে হাওরে পাখিগুলো তিনি দেখেননি। এখন পর্যন্ত কেউ পাখিগুলোকে বিরক্ত করছে, এমনটা দেখেননি তিনি। তবে সবাই উপভোগ করছে পাখির উপস্থিতি। 
হাকালুকি হাওর তীরবর্তী ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার যুধিষ্ঠিপুর গ্রামের  রুমেল আহমদ জানান, এবার হাওরে অন্যবছরের তুলনায় একটু বেশি অতিথি পাখির আগমন ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। সকালে ও বিকালে পাখিদের বেশি দেখা যায়। পাখিরা খাবারের সন্ধানে এক জায়গায় দল না বেঁধে বিচ্ছিন্নভাবে পুরো হাওরে ঘুরে বেড়ায়।

ভূমি সন্তান বাংলাদেশ নামক পরিবেশবাদী সংগঠনের সংগঠক শুয়াইবুল হাসান বলেন, একশ্রেণির লোভী মানুষ এলাকার বিভিন্ন খাল-বিলে নানাভাবে পাখি শিকার করে স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রি করছে। আমাদের জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখার জন্য পাখি বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। পরিবেশ রক্ষায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আরো কঠোর হওয়া জরুরি। 

অবশ্য বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় কর্মকর্তা ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পাখি শিকারিদের বিষয়ে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বন বিভাগের নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সচেতনতা কার্যক্রমও চালিয়ে আসছেন তারা। এবারের অতিথি পাখিশুমারি প্রসঙ্গে বলেন, দু একটি সংস্থা বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে। মাঝে মাঝে যোগাযোগ করে, এবারো কাজ চলমান রয়েছে বলে জানান তিনি। ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, স্বাভাবিক চোখে স্থানীরা জানিয়েছেন বিগত বছরের তুলনায় এবার বেশি অতিথি পাখির আগমন ঘটেছে।  

পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক এমরান হোসেন বলেন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পাখি শিকার বন্ধে জনগণকে নানাভাবে সচেতন করা হচ্ছে। পাখি শিকার ও বিক্রি রোধে মাঝে মাঝে অভিযান হয়। তিনি বলেন, খবর পেলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।